সোমবার ৩ নভেম্বর ২০২৫ - ১০:২৯
মানবজাতির মুক্তির সেবায় না থাকা জ্ঞানই প্রকৃত অজ্ঞতা

বিজ্ঞানের সমর্থনে থাকার পাশাপাশি সাবধান থাকুন; এমন জ্ঞানই প্রচারিত হওয়া উচিত যা সমাজকে রক্ষা করে এবং মানুষকে মানবতার মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। কিন্তু যে জ্ঞান মানুষকে মানুষ হত্যায় উৎসাহিত করে, যুদ্ধ সৃষ্টি করে এবং গণহত্যা ঘটায়—তার কোনো মূল্য নেই।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়াতুল্লাহ্ আল্ উজমা সুবহানীর সাপ্তাহিক নৈতিক পাঠ ১৪ অক্টোবর ২০২৫ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কোমের পারদিসান অঞ্চলের ইমাম সাদিক (আ.) ইনস্টিটিউটে ছাত্র, আলেম ও তাঁদের পরিবারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়।

আয়াতুল্লাহ্ সুবহানী ইমামদের (আ.) শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করে তরুণ ছাত্রদের ভবিষ্যৎ দায়িত্বের গভীরতা অনুধাবন করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সেই জ্ঞানই মূল্যবান যা মানবজীবনকে টিকিয়ে রাখে, সাহায্য করে ও জীবনকে সহজ করে, এমন নয় যে জ্ঞান যা পারমাণবিক অস্ত্র ও গণবিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।

সন্তানদের  ব্যক্তিত প্রদান

তিনি আহলে বায়তের (আ.) শিক্ষণপদ্ধতির উদাহরণ হিসেবে ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর ঘটনা উল্লেখ করেন, যেখানে ইমাম হাসান (আ.) তাঁর নিজের সন্তান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সন্তানদের একত্র করেন এবং বলেন: তোমরা এমন একটি জাতির শিশুরা, যারা শীঘ্রই অন্য এক জাতির প্রবীণ হয়ে উঠবে। তাই জ্ঞান অর্জন করো, আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মুখস্থ রাখতে না পারে তবে তা লিখে রাখো এবং ঘরে সংরক্ষণ করো।

তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন: কাউকে সঠিক পথে আনতে চাইলে আগে তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান বাড়াতে হবে। তোমরাই ভবিষ্যতের মারজা-এ-তাকলিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সমাজের নেতা। তাই সন্তানদের উপদেশ দিতে হলে আগে তাদের সম্মান দিতে হবে, যাতে তারা নিজের চোখে নিজেকে সক্ষম মানুষ হিসেবে দেখতে পারে।

ভবিষ্যতের জন্য বৈজ্ঞানিক বিনিয়োগের প্রয়োজন

ইমাম হাসান (আ.)-এর দ্বিতীয় নির্দেশনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন: জ্ঞান অর্জন করো এবং সংরক্ষণ করো, আর যদি মুখস্থ রাখতে না পারো তবে তা লিখে রাখো।

তিনি যোগ করেন: ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মই দেশের দায়িত্ব নেবে। অশিক্ষিত ও অজ্ঞ মানুষ কোনো সমাজ পরিচালনা করতে পারে না। তাই শিক্ষাই তোমাদের প্রকৃত পুঁজি। কেবল ধর্মীয় শিক্ষা নয়—ফিকহ, দর্শন বা গণিত—সবই মূল্যবান। ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। যার স্মৃতি দুর্বল, তাকে নিয়মিত নোট নিতে হবে এবং তা পুনরায় অধ্যয়ন করতে হবে।

তিনি আলস্য পরিহারের উপরও জোর দিয়ে বলেন, যেমন কবি “তুঘরায়ী” বলেছেন: আরম্ভের ভালোবাসা মানুষকে উচ্চতার পথ থেকে বিরত রাখে এবং আলস্যে নিমজ্জিত করে।
যারা কষ্ট এড়াতে চায় তারা কখনোই উন্নতি করতে পারে না। তাই যারা জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত, তাদের ক্রমাগত অধ্যয়ন করতে হবে-এমনকি ছুটির দিনেও।

আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব ও নাজাতদাতা ভূমিকা

তিনি হাদীস উল্লেখ করেন: জ্ঞানীর মর্যাদা উপাসকের উপর ঠিক যেমন পূর্ণিমার চাঁদের অন্য তারার উপর।

এর ব্যাখ্যায় বলেন, আলেম অন্যদের রক্ষা করতে চায়, আর উপাসক শুধু নিজেকে। নবীগণ সমাজের কল্যাণে আত্মত্যাগ করেছেন বলেই তাঁরা সর্বোচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছেন।

আপনারাও এমন অবস্থানে আছেন যেখানে আল্লাহ আপনাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন; কারণ আপনারা কেবল নিজেকে নয়, অন্যদেরও রক্ষা করেন।

আলেমের কলম—শহীদ তৈরির উৎস

তিনি হাদীস উদ্ধৃত করেন: আলেমদের কলমের কালি শহীদদের রক্তের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

এবং বলেন, প্রথমে এটি বোঝা কঠিন মনে হলেও বাস্তবতা হলো—শহীদকে গড়ে তোলে আলেমের শিক্ষা। যদি শেখ মুফিদ বা শেখ তুসি ও অন্যান্য মহা আলেম না থাকতেন, তবে অনেক শহীদ সেই উচ্চ মর্যাদা পেত না। তাই “আলেমদের কালি” মানে হলো তাঁদের আত্মত্যাগ ও শিক্ষাদান, যা শহীদদের সৃষ্টি করে।

আয়াতুল্লাহ্ বুরুজার্দীর জীবনের শেষ স্মৃতি

তিনি বলেন, জীবনের শেষ দিনগুলোতে আয়াতুল্লাহ্ আল্ উজমা বুরুজার্দী (রহ.) বলেছিলেন, ইচ্ছা করি ‘কাশফে হিজাব’-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতাম এবং শহীদ হতাম, ভয় হয় পরকালে খালি হাতে যাব।

তখন আয়াতুল্লাহ্ গোলপায়েগানি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন: “আলেমদের কালি শহীদদের রক্তের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।”
বুরুজার্দী বলেন, “হ্যাঁ, এ হাদীসটি সহীহ।”
গোলপায়েগানি বলেন, “তাহলে চিন্তার কিছু নেই, কারণ যদি আপনি শহীদ হতেন, আপনার বহু গ্রন্থ ও শিক্ষার বরকত থেকে বঞ্চিত হতেন।”
এতে বুরুজার্দী কিছুটা শান্তি পান। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ, বিশেষত “জামে আহাদিসুশ্‌শিয়া”, সেই কলমেরই ফসল।

ধ্বংসাত্মক বিজ্ঞান: আধুনিক অজ্ঞতার প্রতিফলন

আয়াতুল্লাহ্ সুবহানী সতর্ক করে বলেন: বিজ্ঞানের প্রচারের পাশাপাশি সতর্ক থাকুন-শুধু সেই জ্ঞান প্রচলিত হোক যা সমাজকে রক্ষা করে ও মানবতার উন্নতি ঘটায়। কিন্তু যে বিজ্ঞান মানুষকে মানুষ হত্যায় উৎসাহিত করে, যুদ্ধ ও গণবিধ্বংস ঘটায়, তার কোনো মূল্য নেই।

তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর নাহজুল বালাগা থেকে উদ্ধৃত করে বলেন: অজ্ঞতার যুগে মানুষ ভেতরে ভয় ধারণ করত, কিন্তু বাইরে অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তারা অন্তরে ভীত ও বাহ্যিকভাবে সজ্জিত ছিল-এটাই ছিল অজ্ঞতার চিহ্ন।

তিনি বলেন, আজ পশ্চিমা জগতে ঠিক সেই অজ্ঞতা বিরাজ করছে। দেশগুলো একে অপরকে ভয় পায়, তাই অস্ত্র সঞ্চয় করে। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা মানবতা নয়, এটি জ্ঞানও নয়।

ধারাবাহিক উন্নতির প্রয়োজন

শেষে তিনি হাদীস উদ্ধৃত করেন: যার দুই দিন সমান, সে ক্ষতিগ্রস্ত; যার পরের দিন আগের দিনের চেয়ে খারাপ, সে অভিশপ্ত; যে নিজে উন্নতি অনুভব করে না, সে ক্ষয়প্রাপ্ত; আর যে পতনের পথে, তার জন্য মৃত্যু জীবনের চেয়ে ভালো।

তিনি বলেন, প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিন নিজেকে উন্নত করা, নতুবা তার জীবন অপচয়।

উল্লেখ্য, আগামী বুধবারও নৈতিক পাঠ অনুষ্ঠিত হবে, যদিও তা হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.)-এর শাহাদাতের দিনগুলোর সঙ্গে মিলে যাবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha